এন্ডোস্কোপি (Endoscopy) কি?
এন্ডোস্কোপি (Endoscopy) হচ্ছে চিকিৎসা সহায়ক পদ্ধতি যার মাধ্যমে একটি টিস্যু বা অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এর মাধ্যমে চিকিৎসকগণ বড় ধরণের কোন অস্ত্রোপাচার (Surgery) ছাড়াই পরিপাকতন্ত্র, ফুসফুস বা মূত্রাশরেয়র মতো বিভিন্ন অঙ্গসমূহকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এন্ডোস্কোপি পরিচালনায় একটি দীর্ঘ, নমনীয় এবং পাতলা টিউব যা এন্ডোস্কোপ নামে পরিচিত, মূখ বা মলদ্বারের মতো শরীরের খোলা অংশের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এন্ডোস্কোপের একটি লাইট, ক্যামেরা, ইন্সট্রুমেন্ট পোর্ট এবং এর শেষে পানি ও বাতাসের জন্য একটি পোর্ট রয়েছে।
এন্ডোস্কোপি (Endoscopy) কেন করা হয়?
এন্ডোস্কোপি (Endoscopy) নানাবিধ কারনে করানো হয়। তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারন নিম্নে উল্লেখ করা হ’লো-
- উপসর্গ ও রোগ নির্ণয়: শরীরের বিভিন্ন আভ্যন্তরিন অঙ্গসমূহের বিভিন্ন রোগ সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য এন্ডোস্কোপি (Endoscopy) করানো হয়ে থাকে। যেমন- পেটে ব্যথা হচ্ছে বা খাবার গিলতে সমস্যা হচ্ছে, এমন লক্ষণগুলোর পেছনের কারণ খুঁজে পেতে এন্ডোস্কোপি (Endoscopy) সহজ ও পরিচ্ছন্নভাবে সহায়তা করে।
- চিকিৎসা ও ছোট-খাটো অস্ত্রপাচার- এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা যায়। কিছু রোগের চিকিৎসার জন্য একটি ছোট-খাটো অস্রপাচার করা যায়। যেমন পরিপাকতন্ত্রের কিছু সমস্যার চিকিৎসায় একটি সংকীর্ণ খাদ্যনালী প্রশস্ত করা, রক্তপাত বন্ধ করার জন্য একটি রক্তনালী পুড়িয়ে ফেলা, কোন ফরেন পার্টিকেল অপসারন করা, পলিপ (শরীরের অস্বাভাবিক টিস্যু বৃ্দ্ধি) অপসারণ করা ইত্যাদি।
- বায়োপসি- এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে কোন অস্বাভাবিক টিস্যু বা ভরের একটি ছোট নমূনা নিয়ে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের জন্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাগারে পাঠানো যায়। এটি অ্যানিমিয়া, প্রদাহ, রক্তপাত, ডায়রিয়া বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (পাচন) সিস্টেমের ক্যান্সারের মতো অবস্থাও সনাক্ত করতে সহায়তা করে।
কোন কোন লক্ষণে এন্ডোস্কোপি করানোর প্রয়োজন হতে পারে?
নিম্নলিখিত নানাবিধ কারনের এক বা একাধিন কারণ উপস্থিত থাকলে সাধারণত এন্ডোস্কোপি করানোর প্রয়োজন হতে পারে, যেমন-
- গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল লক্ষণঃ পেটে ব্যথা, অম্লতা, রক্ত বমি, অ্যাসিড রিফ্লাক্স, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, মলে রক্ত, অব্যক্ত এবং হঠাৎ ওজন হ্রাস ইত্যাদি।
- শ্বাসকষ্টের উপসর্গঃ খাবাব গিলতে অসুবিধা, থুতুতে রক্ত, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, শ্বাস নিতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্ট, ব্যথা বা শ্বাস-প্রশ্বাসে পরিশ্রশ ইত্যাদি।
*পেশীর বিভিন্ন উপসর্গ- জয়েন্টে ব্যথা, নড়াচড়ায় সীমাবদ্ধতা, জয়েন্টের নড়াচড়ায় শব্দ, জয়েন্টের স্থানচ্যুতি ইত্যাদি। - মহিলা প্রজনন সিস্টেমের লক্ষণ- যোনী থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত, যোনী থেকে অস্বাভাবিক স্রাব, গর্ভধারণে অক্ষমতা, পেটের নিচের অংশে ব্যথা ইত্যাদি।
এন্ডোস্কোপি করার পূর্ব প্রস্তুতি বা করণীয়:
- উপবাস বা না খেয়ে থাকা: পাচনতন্ত্রের এন্ডোস্কোপির জন্য, পদ্ধতির আগে ছয় থেকে আট ঘন্টা উপবাস প্রয়োজন। এই সময়কালে কিছু খাওয়া বা পান করা এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ যাতে প্রক্রিয়া চলাকালীন পেট খালি থাকে।
- ঔষধ পর্যালোচনা: রোগীর বর্তমান চলমান ঔষধগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করতে হবে। যদি একজন রোগী রক্ত পাতলা করার ওষুধ যেমন ক্লোপিডোগ্রেল বা ওয়ারফারিন ইত্যাদি গ্রহণ করেন, তবে রোগীকে পদ্ধতির কয়েকদিন আগে রক্ত পাতলা করার ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে বলা হতে পারে, কারণ রক্ত পাতলাকারী ওষুধগুলি রক্তপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। কোলন পরীক্ষার ক্ষেত্রে রোগীর অন্ত্র পরিষ্কার করার জন্য পদ্ধতির এক দিন আগে তাকে রেচক দেওয়া যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, সংক্রমণের সম্ভাবনা কমাতে আগে থেকেই অ্যান্টিবায়োটিকগুলি নির্ধারণ করতে হয়।
- আরামদায়ক পোশাক- রোগীকে আরামদায়ক পোশাক পরিধান করা উচিৎ, মহিলাদের গয়না এড়িয়ে চলতে হয়।
- পরিবহনের পূর্বব্যবস্থাপনা- এন্ডোস্কোপি সম্পাদনের পরে সাধারনত কোন গাড়ী, মোটরসাইকেল ইত্যাদি ড্রাইভ করার অনুমতি দেয়া নাও হতে পারে। তাই পূর্বথেকেই রোগীকে বাড়ী নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নির্ধারিত থাকা বাঞ্ছনীয়।
এন্ডোস্কোপি কিভাবে সঞ্চালন করা হয়?
- প্রয়োজনীয় প্রস্তুতীর পর রোগীকে তাদের পিঠে বা পাশে শুয়ে রাখা হয়। প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার, রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন মনিটরিং করার জন্য শরীরের সাথে বিভিন্ন মনিটর সংযুক্ত থাকে।
- রোগীকে শিথিল করতে ও প্রক্রিয়াটিকে আরামদায়ক করতে সাধারনত বাহুতে শিরা দিয়ে একটি উপশমকারী দেওয়া হয়। তারপর অ্যানেশেসিয়া দেওয়া হয়। প্রদত্ত অ্যানেশেসিয়া সাধারণ বা স্থানীয় হতে পারে। এন্ডোস্কোপ টিউব ঢোকানোর ক্ষেত্রে গলা অসাড় করার জন্য ডাক্তার মুখে অ্যানেশেসিয়া স্প্রে করতে পারেন।
- অতপর এন্ডোস্কোপটি মুখের মধ্য দিয়ে বা নির্দেশিতভাবে একটি ছেদ দিয়ে দেওয়া হয়। মুখে ঢোকানো হলে, ডাক্তার রোগীকে গিলে ফেলতে বলা হবে। এই পদ্ধতির সময় কেউ গলায় সামান্য চাপ অনুভব করতে পারে, তবে কোন ব্যথা জড়িত হওয়া উচিত নয়। এন্ডোস্কোপ রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসে হস্তক্ষেপ করবে না, যদিও এন্ডোস্কোপ একবার মুখের ভিতরে থাকলে রোগী কথা বলতে পারবেন না।
- একবার এন্ডোস্কোপ খাদ্যনালীতে (খাদ্য পাইপ) চলে গেলে, ডাক্তার এন্ডোস্কোপের ডগায় থাকা ক্ষুদ্র ক্যামেরার সাথে সরাসরি সংযুক্ত মনিটরের মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা দেখবেন। যদি কোন অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, ডাক্তার ভবিষ্যতে রেফারেন্সের জন্য এই চিত্রগুলি রেকর্ড করবে।
- পাচনতন্ত্রকে স্ফীত করার জন্য এন্ডোস্কোপের মাধ্যমে খাদ্যনালীতে মৃদু বায়ুচাপ দেওয়া যেতে পারে, এলাকাটির দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে এবং এন্ডোস্কোপকে অবাধে চলাচল করতে দেয়। এতে ডাক্তারগণ পাচনতন্ত্রের ভাঁজগুলি পরীক্ষা করতে পারেন। এভাবে ইনভেসটিগেশন বা প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। টিস্যু নমুনা সংগ্রহ, পলিপ অপসারণ ইত্যাদির মতো প্রক্রিয়াগুলি সম্পাদন করার জন্য বিশেষ অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামগুলি এন্ডোস্কোপের মাধ্যমে পাস করা যেতে পারে।
- প্রক্রিয়া সম্পন্নের শেষে এন্ডোস্কোপ ধীরে ধীরে মুখের মাধ্যমে সরানো হয়। একটি আক্রমণাত্মক এন্ডোস্কোপির (invasive endoscopy) ক্ষেত্রে যা একটি ছেদনের মাধ্যমে করা হয়, ছেদগুলি পরে সেলাই করা হয় এবং একটি ড্রেসিং দেওয়া হয়।
- অতঃপর রোগীকে পর্যবেক্ষণের জন্য রিকভারি রুমে পাঠানো হয়। রোগীকে সাধারণত প্রায় এক ঘন্টা এখানে থাকতে বলা হয় যাতে স্বাস্থ্যসেবা দল রোগীর উপর নজর রাখতে পারে। পুনরুদ্ধারের সময়কাল সঞ্চালিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে কম-বেশী হয়, তবে বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক এন্ডোস্কোপি পদ্ধতিতে রোগী সেদিনেই বাড়ি চলে যেতে পারেন। তবে রোগীকে এন্ডোস্কোপি সম্পাদনের পরে সাধারণত ২৪ ঘন্টা বিশ্রামের পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ রোগীর সতর্ক থাকা সত্ত্বেও সেডেটিভের প্রভাবের কারণে একজনের বিচার এবং প্রতিক্রিয়ার সময় প্রভাবিত হতে পারে।
এন্ডোস্কোপি কি খুব ঝুঁকিপূর্ণ?
না, এন্ডোস্কোপি একটি নিরাপদ রুটিন পদ্ধতি এবং এর ঝুঁকি খুব কম। তবে এন্ডোস্কোপি করানোর পর কোন কোন রোগী পেট ফুলে যাওয়া, ক্র্যাম্পিং, নিদ্রাহীনতার কারণে বিভ্রান্তির অনুভূতি, হালকা রক্তপাত, গলা ব্যথা, ছেন স্থানে (যদি করা হয়) হালকা ব্যথা অনুভব করতে পারেন। এছাড়াও পাকস্থলী, খাদ্যনালী বা অন্ত্রের আস্তারণের ছিদ্র বা ছিঁড়ে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ অঙ্গে আঘাত, ইনভেস্টিগেশন এলাকার সংক্রমন, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, এন্ডোস্কোপি সঞ্চালিত এলাকায় ক্রমাগত ব্যথা, পূর্ব-বিদ্যমান কোন অবস্থার কারণে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। এন্ডোস্কোপি সম্পাদনের পর এমন কোন সমস্য থাকলে উপসর্গ হিসেবে সাধারণত জ্বর, পেটে সাংঘাতিক ব্যথা, বুক ব্যথা, বমি, নিঃশ্বাসের দূর্বলতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, অত্যধিক রক্তপাত, কাটা যায়গায় ব্যথা ও প্রদাহ, ছেদ থেকে স্রাব, গাঢ় রঙ্গের মল ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। যদি এসব উপসর্গগুলোর যে কোন এক বা একাধিক উপসর্গ দেয়া দেয়, তবে অনতিবিলম্বে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।